Featured

PhysicistPhysicsScholarScientistSubject

ফ্যাশন, ফ্যান্টাসি, কৃষ্ণবিবর– রজার পেনরোজের বৌদ্ধিক জগৎ

, অক্টোবর ০৯, ২০২০ WAT
Last Updated 2021-03-25T05:32:16Z

Physics কাকে বলে রসায়নে নোবেল বিজয়ীদের তালিকা পদার্থবিজ্ঞানী অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ীদের তালিকা আলফ্রেড বার্নার্ড নোবেল নোবেল পুরস্কার ২০১৮ নোবেল অর্থ নোবেল পুরস্কার ২০১৭
পদার্থবিজ্ঞানে ২০২০ সালের তিন নোবেল বিজয়ীর ছবি


স্টিফেন হকিঙের বই ও নামযশের সাথে তরুণ বয়সে আরেকটি যে নাম আমাদের ঠোঁটস্থ হয়ে গিয়েছিল, সে হল রজার পেনরোজ। বয়সে হকিঙের কিছুটা বড়, কিন্তু মেধায় মননে গণিতের সূত্রায়নে প্রায় একই ধারার মানুষ। কিছুটা হয়ত বেশিও। পেনরোজের কাজ গণিত নিয়ে। তিনি গণিতের জগতের লোক। কিন্তু বিশ শতকের ষাটের দশক আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব নিয়ে মুহ্যমান।

আইনস্টাইনের এ অসাধারণ তত্ত্বীয় কাঠামোটি কয়েক প্রজন্মের তরুণ মেধাকে বেঁধে রেখেছিল এর চর্চায়। পেনরোজ গণিতবিদ হলেও তিনিও এ ফ্যাশন থেকে বিযুক্ত থাকতে পারেননি। পেনরোজের নিজস্ব প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল গণিতের বিশুদ্ধ বীজগাণিতিক ধারায়। তার পিএইচডি গবেষণাও অ্যালজেব্রার উপর এবং সেইসময়ের একজন বিশিষ্ট অ্যালজেব্রাইস্টের (জন টড) অধীনে। এরপর তিনি শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ষাটের দশকের শুরুর দিকে তিনি কেম্ব্রিজের বিখ্যাত অধ্যাপক ডেনিস সিয়ামার সাথে পরিচিত হন এবং তার প্রভাবে বীজগণিতের বিমূর্ত ও বিশুদ্ধ জগৎ ছেড়ে জ্যোতির্পদার্থবিদ্যায় আকৃষ্ট হন। এ সময়ে তিনি ভারী ও ঘনবস্তুর মহাকর্ষীয় পতন নিয়ে ভাবনা শুরু করেন। অবশ্য সেই সময়ে ঠিক ওই বিষয়ে গবেষণার একটা ক্ষেত্র তৈরিই ছিল।

অনেকেই নক্ষত্রের মহাকর্ষীয় পতন নিয়ে চিন্তা ভাবনা করছিলেন। এর মধ্যে কার্ল সোয়ার্জচাইল্ড, রয় কের, রবার্ট ওপেনহাইমার, হার্টল্যান্ড স্নাইডার, জন হুইলার প্রমুখ। এরা নানাভাবে গোলকীয়ভাবে প্রতিসম ভারী বস্তু, যেমন নক্ষত্র, এর মহাকর্ষের অধীনে ক্রমাগত সংকোচনের সম্ভাবনার বিষয়ে নানাভাবে ভাবছিলেন। সকলের ভাবনা একই ধারায়ও ছিল না, কিন্তু সমাধানের গতিপ্রকৃতি একটা নির্দিষ্ট ফলাফলের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। এভাবে বলা যায়, তারা সকলেই জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে গোলকীয়ভাবে প্রতিসম নক্ষত্র বা বস্তুপিণ্ডের মহাকর্ষীয় সংকোচন বা কোলাপ্স নিয়ে ভাবছিলেন। ‘কোলাপ্স’ও বলা যায় কিনা সন্দেহ, কেননা ১৯৩৯-১৯৬৪ সালের পরিসরে ওই শব্দটা ছিলনা। সোয়ার্জচাইল্ডের বিখ্যাত সমীকরণে একটা বিশেষ পরিস্থিতির কথা বলে, একটা দিগন্তের উপস্থিতির ইঙ্গিত দেয়, যে দিগন্তের ভেতরে সমস্ত যোগাযোগ শূন্য হয়ে যাবার একটা সম্ভাবনা থাকে। এটা তখন কেউই মানতে রাজি ছিলেন না। আর্থার এডিংটন এর বছর দশেক আগেই বলেছিলেন, ‘ওসব চলবে না, জগতে নক্ষত্রের রক্ষায় আরো কিছু নিশ্চয় থাকবে।’ এসব বলে তিনি তখনকার উদীয়মান গবেষক সুব্রাহ্মন্যন চন্দ্রশেখরের নিউট্রন তারার কাজকে খারিজ করে দিয়েছিলেন। এরকম একটা ডামাডোলের মধ্যে পেনরোজ সম্পূর্ণ নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে ঘটনার ব্যাখ্যায় প্রয়াসী হলেন। 

তিনি এমন এক ছকচিত্র আঁকার উপায় বাতলে দিলেন যা দিয়ে স্থানকালের চিন্তাভাবনা ভীষণভাবে বদলে গেল। কিপ থর্নের ভাষায় “স্থানকালের প্রকৃতি বিষয়ক চিন্তাভাবনায় যুগান্তকারী গাণিতিক টুল” হল সেই বিখ্যাত পেনরোজ ডায়াগ্রাম। এই ডায়াগ্রামের মাধ্যমে তিনি দেখালেন, আসলেই ঘনীভূত বস্তুর মহাকর্ষীয় সংকোচন সম্ভব এবং অন্তে একটা ব্যতিক্রমী বিন্দুর উপস্থিতি অবশ্যম্ভাবী যদি বস্তুপিণ্ডের শক্তি-ঘনত্ব ধনাত্মক হয়। 

পেনরোজের দেখানো এই পথটি ছিল একরকমের টপোলজিকাল পথ – এটা এমন এক উপায় বাতলে দিল যা দিয়ে স্থানকালে ঘটনার বিবর্তন গণনায় নতুন চিন্তার পথ খুলে গেল। আগে যেটা ভাবা যাচ্ছিল না, সেটা সুন্দরভাবে বিশ্লেষণে উঠে এল। স্থানকাল বা স্পেসটাইমের গুণাগুণ বর্ণনায় এ এক দারুন প্রয়োগ। ট্র্যাপড সারফেস বা আটকে পড়া পৃষ্ঠ সংক্রান্ত তার দেখানো পথেই পরবর্তীতে হেঁটেছেন ডেনিস সিয়ামার বিখ্যাত ছাত্র প্রয়াত বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং। পেনরোজের সাথে মিলে হকিং পরবর্তীতে দেখিয়েছেন, ভারী নক্ষত্রের অন্তিমে শুধু ব্ল্যাকহোল সিংগুলারিটি থাকে না, এদের কসমোলজিকাল পরিণতিও থাকতে পারে। অন্যভাবে বললে, ধনাত্মক শক্তি-ঘনত্বের একটি মহাবিশ্বে যদি জেনারেল রিলেটিভিটি খাটে তবে সেরকম বিশ্বের আদিতে একটি ব্যতিক্রমি বিন্দু বা সিঙ্গুলারিটির অস্তিত্ব অবশ্যম্ভাবী। এটাই হকিং-পেনরোজ থিওরেম নামে বিখ্যাত। তবে হকিঙের সাথে পেনরোজের কাজের ঠিক আগের ধাপ পর্যন্তই ২০২০ নোবেল পুরস্কারের বিষয় সীমাবদ্ধ। ফলে প্রয়াত স্টিফেন হকিঙের সাথে আজকের নোবেল পুরস্কারের সম্পর্ক ঠিক এখানেই শেষ হয়। পেনরোজ তার এই কাজটির মাধ্যমে দেখিয়েছিলেন কীভাবে ও কেন কৃষ্ণবিবর অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে, একে দেখা না গেলেও। 

পেনরোজ কিন্তু এখানেই থেমে থাকেন নি। হকিঙের সাথে তার আলোচনা, গবেষণা এমনকি বিতর্কও সাড়া জাগিয়েছিল আশি এবং নব্বই দশকে। তাদের যৌথ গ্রন্থ ‘দ্য নেচার অব স্পেসটাইম’ এ বিষয়ে তাদের মতামত, গবেষণা এমনকি মতদ্বৈততা প্রকাশ পেয়েছে। তিনি বলেছেন, “আমি যেখানে প্লেটোনিস্ট বা আদর্শবাদী, হকিং সেখানে পজিটিভিস্ট বা যৌক্তিক দৃষ্টবাদী।” ডেটার বাইরে হকিং যাবেন না, তবে পেনরোজ একটা সুপ্ত প্যাটার্নের আশা করেন। কেন করেন তার ব্যাখ্যায় পেনরোজ তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘এম্পেরর্‌স নিউ মাইন্ড’ (১৯৮৯) বইটি লিখেছিলেন।  এই বইটি পেনরোজকে ভুবনজোড়া খ্যাতি এনে দিয়েছে। মনে রাখতে হবে, এর ঠিক এক বছর আগেই বেরিয়েছে হকিঙের ‘আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’। কিন্তু পেনরোজ শুধু মহাবিশ্বের ঠিকুজি নিচ্ছেন না, তিনি চেতনার মূল খুঁজতে গিয়ে লিখে ফেললেন, এই ভয়াবহ চিন্তাশীল বইটি। বইটি ঢাউস। সেখানে কসমোলজি যেমন আছে, ম্যাক্সওয়েল সমীকরণ যেমন আছে, নিউরনের ভেতরে মাইক্রোটিউবিউলে কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনে চিন্তার উদ্রেক হয় কিনা সেই থিওরিও আছে, আছে টুরিং মেশিন, মান্ডেলব্রট সেট, গণিতে চিন্তার প্রয়োজনীয়তা, প্লেটোনিক সলিড, সার্লির অনুবাদক ও অন্যান্য দার্শনিক সমস্যা। গণিতের বিশুদ্ধতার উৎস সন্ধানে তিনি বলেছেন, “এটা কোনো অটোমাটা নয়। এটা অসংখ্য নিউরনের সংযোগ থেকে আপনাআপনি আসবে না।” কীভাবে আসবে তবে চেতনা- তার সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা তিনি দেননি বটে, কিন্তু চিন্তার যে পথ দেখিয়েছেন তা আমাদের মত তরুণদের সেই সময় ব্যাপক ভাবিয়েছে। এই গ্রন্থের পরেও তার আরও গ্রন্থ বেরিয়েছে – শ্যাডোজ অব দ্য মাইন্ড (১৯৯৪), যেখানে তিনি চেতনার সেই পূর্বতন প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজেছেন; এর দশ বছর বাদে ঢাউস ১০০০ পাতার মহাগ্রন্থ রোড টু রিয়ালিটি (২০০৪), যেখানে গণিত ও পদার্থবিদ্যার গোড়ার ভাবনাগুলি থেকে তিনি বাস্তবতার সন্ধান করেছেন; অনেকেই এই বইটিকে আন্ডারগ্র্যাড পদার্থবিদ্যার বুনিয়াদি টেক্সট হিসেবে দেখতে পছন্দ করেন, কেউ কেউ ফাইনম্যান লেকচার্স অব ফিজিক্সের পাশাপাশি চিন্তার সংশ্লেষণী ধারা পরখ করতে এই বইটা চেখে দেখার পরামর্শ দিয়েছেন, তবে পদার্থবিদ্যার জন্য প্রয়োজনীয় গাণিতিক পদ্ধতিগুলি জানার জন্য এ বইটি খুবই প্রয়োজনীয়; সাইক্‌লস অব টাইম (২০১০), যে বইয়ে তিনি সময় নিয়ে আমাদের ভাবনাকে স্পষ্ট করেছেন, থার্মোডিনামিক্সের দৃষ্টি দিয়ে এনট্রপির ব্যাখায় এর চেয়ে ভাল বই আমি দেখিনি;

তিনি এ বইয়ে অসীমভাবে পুনরাবৃত মহাবিশ্বের সম্ভাবনার কথা জানিয়েছেন (বইটি আমাকে বিলেত থেকে এনে দিয়েছিলেন প্রয়াত অধ্যাপক এ আর খান); ফ্যাশন ফেইথ ফ্যান্টাসি (২০১৬), বইটা পদার্থবিদ্যার হাল আমলের গতিপ্রকৃতি নিয়ে এক দারুন সিন্থেসিস, পড়তে গিয়ে দাঁত বসাতে পারা যায়না, অথচ খুব নিরাসক্তভাবে আধুনিক বিজ্ঞানের বিষয়গুলো তিনি রেট্রোস্পেকটিভের কায়দায় বলে গেছেন, তবে কিছুটা যেন উদ্দেশ্যহীন বলে মনে হয়, মনে রাখতে হবে, লেখক তখন ৮৫-ঊর্ধ্ব। শেষের এই বইয়ে তিনি স্ট্রিং থিওরির বহুমাত্রিক পরিণতি সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করেছেন, ফ্যাশনেবল হওয়াই প্রকৃতির উদ্দেশ্য নিশ্চয় নয়, কসমোলজির বিষয়ে আমাদের কল্পনার দুঃসাহসিক অভিযাত্রার কথা বলেছেন, কোয়ান্টাম তত্ত্বে আমাদের অতিরিক্ত আস্থা বা বিশ্বাস আমাদের ভুলপথে যেন না নেয় এমন আশাবাদ তিনি ব্যক্ত করেছেন।

এইসব বইগুলো পেনরোজের প্রায় নবতিপর বয়সী বিজ্ঞান যাত্রার অভূতপূর্ব বয়ান। এই ভদ্রলোক আমার তারুণ্যের সময়কার ব্যাপক চিন্তার উদ্রেককারী এক ক্ষণজন্মা মানুষ, তিনি আজও চমৎকার, আজও তিনি গভীর চিন্তা সৃজনে সক্ষম, তিনি আমার তারুণ্যের নায়ক, তিনি ২০২০ সালের পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক রজার পেনরোজ। 

পেনরোজ, 

আপনি রোজ রোজ,

গাণিতিক বিমূর্ততায় 

আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যান, 

প্লেটোর জগতে।

যার ইশারায়

ছায়ার জগতে

পড়ে বাস্তবের মায়াময় প্রচ্ছায়া। 

চিন্তার গণিতে

জাদুবাস্তব কাঠিতে

যেন লাগে 

ফ্যাশন আর ফ্যান্টাসির

পরাবৌদ্ধিক ছোঁয়া।

লিখেছেন - ফারসিম মান্নান মোহাম্মদী

শিক্ষক

বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় - বুয়েট (BUET)